অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা যুগে যুগে নবী-রাসুলসহ সব সংস্কারক ও মুক্ত-মনা মানুষদের অন্যতম প্রধান আদর্শিক লক্ষ্য। ইরানের ইসলামী বিপ্লবও শুরু হয়েছিল সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার শ্লোগান দিয়ে পবিত্র কুরআনের কাঙ্ক্ষিত ন্যায়বিচার-ভিত্তিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে।
বাংলাদেশেও পবিত্র কুরআনের বিধান দিয়ে দেশ পরিচালিত হউক তা দেশের অধিকাংশ মুসলমান কামনা করেন।
ন্যায়বিচার হল একটি মানবিক আদর্শ যা মানুষের কাছে প্রথম থেকেই হৃদয়ের লালিত আকাঙ্ক্ষা হিসাবে পরিচিত এবং তারা এটিকে বিধি-বিধান ও বিচারের ভিত্তি বানিয়েছে। বৈষম্য, মজলুমের অধিকার পদদলন ও অন্যায়-অবিচার হৃদয়কে করে যন্ত্রণা-ক্লিষ্ট। সামাজিক ন্যায়বিচার না থাকার কারণেই এর প্রতিবাদে যুগে যুগে গড়ে উঠেছে অনেক সামাজিক আন্দোলন ও বিপ্লব। পার্সটুডের এই প্রবন্ধে আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেব পবিত্র কুরআনের বক্তব্য ও চেতনার আলোকে:
ন্যায়বিচারের অর্থ : আমিরুল মুমিনিন হযরত আলীর মতে অধিকারীকে তাঁর প্রাপ্য অধিকার দেয়াই হল ন্যায়বিচার। এ ছাড়াও তাঁর মতে বাড়াবাড়ি বা শৈথিল্যের বিপরীতে মধ্যপন্থা বা ভারসাম্যই হচ্ছে ন্যায়বিচার। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদটিও আগ্রাসন, বৈষম্য দূর করা ও তথাকথিত নিপীড়ন-মুক্ত রাষ্ট্র-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলে এবং এর সব উপধারায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও তাদের অধিকারের বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই ঘোষণায় স্বাক্ষরকারী বৃহৎ শক্তিগুলোই এসব আইন বা রীতি লঙ্ঘন করছে।
প্রাচীন যুগের দার্শনিক ইবনে রোশদ, ইরানী দার্শনিক ইবনে সিনা, আল্লামা তাবাতাবায়ি ও শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মুতাহ্হারি এবং সর্বোপরি ইমাম খোমেইনি (র) ন্যায়বিচার-ভিত্তিক সরকার-ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়ে গেছেন। ইমাম খোমেইনির দৃষ্টিভঙ্গিকে যে বিষয়টি আরও উজ্জ্বল করে তোলে তা হল তিনি কেবল কথায় বা তত্ত্বে সন্তুষ্ট ছিলেন না এবং তিনি ন্যায়বিচারের ধারণাটিকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেছেন। যারা ন্যায়বিচারের জন্য তৃষ্ণার্ত ছিল তিনি সেই জনসাধারণের সাহায্য নিয়ে কুরআনের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
কুরআনের দৃষ্টিতে সামাজিক ন্যায়বিচারের গুরুত্ব : পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে সামাজিক ন্যায়বিচার এতটাই মূল্যবান যে, আল্লাহ তা সুস্পষ্ট ও জোরালোভাবে আদেশ করেছেন এবং বাধ্যতামূলক করেছেন। কুরআন আমাদের এটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে বিরোধীদের অনাচার ও শত্রুতা যেন মুসলমানদেরকে ন্যায়বিচারের পথ থেকে বিচ্যুত না করে, বরং তারা যেন শত্রুর সঙ্গেও ন্যায় আচরণ করে। এরই আলোকে পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা নবী-রাসুলগণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। মানব-সমাজে পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কুরআনের এই নীতি মহানবী (সা)’র আচরণ ও চরিত্রেও ছিল দেদীপ্যমান। এ প্রসঙ্গে মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম বাকির-আ. বলেছেন, মহানবী সা. জাহেলি প্রথাগুলো বিলুপ্ত করেছেন এবং মানুষের সঙ্গে আচরণে ন্যায়বিচার শুরু করেছেন।
সমাজে ন্যায়বিচারের গুরুত্ব অপরিসীম হওয়ায় কুরআন নানা ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের ধারণাকে সার্বজনীন করেছে। সাক্ষ্য দেয়ার দেয়ার সময়, কথা বলার সময়, বিচারিক কাজ করার সময়সহ জীবনের সব ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারে অবিচল থাকার ওপর জোর দিয়েছে। কুরআনের দৃষ্টিতে যা কিছু অনাচার তৈরি করে ও ন্যায়বিচারের চেতনাকে গুড়িয়ে দেয় তা-ই দুরাচার এবং কুরআন সেসবকে নিষিদ্ধ করেছে; এমনকি একটি মিথ্যা সংবাদও সমাজের ব্যক্তিদের ওপর কার্যকর প্রভাব ফেলে। ভারসাম্যপূর্ণ সমাজে যদি সবার কাছে ক্ষমতা, সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধাগুলো একই ধরনের হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে সবার মধ্যে সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। হযরত আলী-আ. বলেছেন, ন্যায়বিচার হৃদয়গ্রাহী ও ঘনিষ্ঠতা আনে। সমাজে ন্যায়বিচারের বিপরীত হল জুলুম ও অন্যায় যা মহান আল্লাহকে করে ক্রুদ্ধ ও মানুষে মানুষের সৃষ্টি করে শত্রুতা এবং ঘটায় সভ্যতাগুলোর বিলুপ্তি তথা মানব-সমাজের ধ্বংস সাধন।
ন্যায়বিচার–ভিত্তিক সরকার গঠন : সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে জরুরি শর্ত হল রাষ্ট্র বা সরকার গঠন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছিল নবী-রাসুলগণের আগমনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। তাঁরা ও তাঁদের উত্তরসূরিগণ এ কারণেই রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। নেতৃত্বের লোভ, বেশি পাওয়ার ইচ্ছা, বৈষয়িক স্বার্থ ও আরাম-আয়েশ তাঁদের লক্ষ্য ছিল না। পবিত্র কুরআন বলে, নিশ্চয়ই আমরা নবী-রাসুল পাঠিয়েছি নিদর্শন বা প্রমাণ সহকারে এবং তাদের কাছে পাঠিয়েছি ধর্মগ্রন্থ ও ন্যায়ের মানদণ্ড যাতে তারা জনগণের মধ্যে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা করেন (সুরা হাদিদ, ২৫ নম্বর আয়াত)। তাঁরা যদি কেবল জনগণের পরকালকে নিরাপদ করারই দায়িত্ব পেতেন তাহলে কেউই তাঁদের সঙ্গে শত্রুতা করত না। ইসলামী আইন প্রণয়ন ও সেসবের বাস্তবায়ন, বিশেষ করে অর্থনৈতিক বিধি-বিধান বাস্তবায়নের জন্য সরকার গঠন জরুরি। এ কারণেই দাউদ নবীর পুত্র হযরত সোলায়মান ও মহানবী (সা.) একটি সরকার গঠনের চেষ্টা করেছেন ও এর আওতায় জনগণের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হয়েছেন।
মানবীয় পূর্ণতা ও উন্নতির জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা জরুরি : মানুষের সৃষ্টি ও ধরার বুকে মানুষকে পাঠানোর উদ্দেশ্য হল তাদের পরিপূর্ণতা দেয়া। মানুষ কেবল সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। যখন সমাজের প্রত্যেক মানুষ দেখতে পাবে যে তার অধিকারগুলো সুরক্ষিত এবং তাদের মানবীয় সত্তা ও মর্যাদাকে সম্মান দেয়া হচ্ছে তখন সমাজের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটবে এবং তখন তারা সমাজের জন্যও কল্যাণে আগ্রহী হবে। জুলুম হচ্ছে একটি সমাজের জন্য ধ্বংসাত্মক এবং তা সভ্যতা ও জাতিগুলোর ধ্বংস ডেকে আনে। ব্যক্তির পরিশুদ্ধি ও সমাজের নীতি ও আচরণ সংশোধনের জন্য এবং পূর্ণতার দিকে পথ প্রদর্শনের জন্য জীবনের সব ক্ষেত্রে –এমনকি খুব তুচ্ছ বিষয়েও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় পবিত্র কুরআন।
পবিত্র কুরআনের ষোলতম সুরা তথা সুরা নাহ্ল-এর নব্বুই নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ এবং অবাধ্যতা করতে বারণ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা স্মরণ রাখ।
সুরা শুরার ১৫ তম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, বলুন, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, আমি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমি তোমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করতে আদিষ্ট হয়েছি।
সুরা আরাফের ২৯ নম্বর আয়াতেও মহান আল্লাহ বলেছেন: হে নবী আপনি বলে দিন: আমার প্রতিপালক সুবিচারের নির্দেশ দিয়েছেন। সুরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী তোমাদের চাইতে বেশী। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কেই অবগত।
পবিত্র কুরআনের এইসব আয়াত থেকে ন্যায়বিচারের অশেষ ও অপরিহার্য গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। পার্স টুডের সৌজন্যে।
Leave a Reply